ফারুক আহমেদ
গ্রাম বাংলার প্রকৃতির যতগুলো রূপ আছে, হেমন্তের পর শীত তার মধ্যে অন্যতম । কুয়াশার সকালে, সবুজ ঘাসের উপর মুক্তোর মতো শিশির বিন্দু, আর হলদে রঙের সরিষা ফুলের সৌরভ যেন গ্রাম বাংলার সোন্দর্য্যকে আরো বাড়িয়ে দেয় । শীত মানেই গ্রাম বাংলার বিয়ে, খেলাধুলাসহ নানা উৎসবের আয়োজন ।
শীত নিয়ে বিখ্যাত কবি সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা “শীতের সকাল” এ কবি লিখেছেন —
শীত শীত, বড় শীত,—শরীর কাঁপায়,
দাওয়ায় পড়েছে রোদ, বসেছি সেথায়।
নদীটির একপাশে মোদের কুটির,
তার ধারে ছোট ক্ষেত মটরশুঁটির;
ভিজে-ডানা প্রজাপতি আসে আর যায়,
থর্ থর্ কাঁপে যেন হিমেল হাওয়ায়।
হিমে-ভেজা দুনিয়াটা করে ছল্ ছল্;
কখন নেমেছে জানি হিমের বাদল!
শীতকালে এক সময় গ্রাম বাংলায় হতো ষাঁড় দৌড়, ঘোড় দৌড় এবং মোরগ দৌড় এর বিশাল আয়োজন ! হতো পিঠা মেলা সহ নানা মেলার আয়োজন ! শীতের সকালে মায়ের হাতের ভাপা পিঠা খাওয়ার স্মৃতি, খেজুরের রস খাওয়ার স্মৃতি আজও মনে পড়ে । সেই শীতের সময় আমরা গ্রামের স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়াবান্দা, ভলিবল ও বেডমিন্টন খেলতাম ! চলতো বড়ো ভাইদের প্রতিদিন, বিশেষ করে ছুটির দিনে ভলিবল খেলা । সেই সময় বড়ো ভাইদের সাথে থেকে, পিছন থেকে দু’একটি বল মারতে পারলে, আর দূরে চলে যাওয়া বল এনে দিতে পারলেই যেন পেতাম অনেক আনন্দ ! সম্প্রীতি গ্রামে-গঞ্জে সেই খেলা অনেকটা হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে ক্রিকেট খেলা !
পূর্বশীলমান্দি, মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম । এই গ্রামে রয়েছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, আইনজীবী সহ বিভিন্ন পেশার চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী, কর্মজীবী ও সাধারণ কৃষক। এক সময় গ্রামের কল্যাণে অনেকেই কাজ করেছেন। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন ছিল পূর্বশীলমান্দি ক্লাব । যে ক্লাবে হতো প্রতিদিন বিকেলে কেরাম বোর্ড খেলা, পত্রিকা পড়া । ছুটির দিনে চলতো সাদা কালো টিভিতে নাটক দেখা ! হতো গ্রামের মোল্লাবাড়ির বড়ো উঠানে সিরাজদৌল্লা, রূপবান সহ নানা যাত্রা অনুষ্ঠানের আয়োজন !
সম্প্রতি পূর্বশীলমান্দী গ্রামের নুতন প্রজন্ম এবং আমাদের পরের প্রজন্ম সবাই মিলে তৈরি করেছে “পূর্বশীলমান্দি ওয়েলফেয়ার সোসাইটি” । যে ওয়েলফেয়ার সোসাইটির তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে লিটন গাজী, হুমায়ুন গাজী, এ বি এম মনিরুল হক, রাশেদুল ইসলাম, পলাশ সাদিক , নাজমুল ইসলাম,আরাফাত ইয়াসিন, সুমন মোল্লা সহ আরও অনেকে ।
আমি ইতিমধ্যেই ওদের সাথে কয়েকটি মিটিং এ কথা বলেছি ! ওদের অনেকের সাথে কথা বলার পর আমার মনে হয়েছে,
“ওরা প্রত্যেকটি টীম মেম্বার খুবই ভালো মনের মানুষ, সৎ এবং নিষ্ঠাবান ! গ্রামে একসময়কার ঘুনে ধরা সমাজের মানুষের মনমানসিকতার সাথে ওদের মিল নেই ! ওরা সবাই “নুতন বাংলাদেশের” সত্য ও ন্যায়ের পথে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক একটি সৈনিক । ওরা প্রত্যেকেই চায় সমাজকে ভালো কিছু উপহার দিতে ! ওদের দেখেআরও মনে হয়েছে , ওরা সত্যিই পারবে পূর্বশীলমান্দি গ্রামের উন্নতি করতে! ওরা পারবে সমাজের দুর্নীতি এবং অনাচার দূর করে গ্রামে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে, গ্রামকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিতে । ওদের জন্য একান্ত প্রয়োজন হবে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও শক্তিশালী লিডারশিপের পরামর্শ ও সহযোগিতা ! যে দিতে পারবে ওদের সঠিক দিকনির্দেশনা, জোগাতে পারবে সাহস এবং অনুপ্রেরণা !”
ওদের সবার প্রতি আমার পরামর্শ হলো,
“তোমাদেরকে নিতে হবে লংটার্ম পরিকল্পনা ! থাকতে হবে তোমাদের একটি সুন্দর ও পরিকল্পিত সংবিধান বা নীতিমালা ! তোমাদের পরিকল্পনা এমন ভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে আজ থেকে ২০-৫০ বছর পর গ্রামের মানুষ যেন হয় ১০০% শিক্ষিত । গ্রামের যেন থাকে না কোনো দরিদ্র পরিবার ! না যেন থাকে গ্রামে কোনো দুর্নীতি ও অনাচার ! গ্রাম চলবে নিজস্ব সংবিধানে, ঠিক যেন “নাটোরের হুলহুলিয়া” আদর্শ গ্রামের মতো ! পূর্বশালমান্দী গ্রাম যেন সেদিন (২০-৫০ বছর পর) পরিণত হয় একটি পরিপূর্ণ আদর্শ গ্রাম ! পূর্বশীলমান্দী গ্রাম যেন হয় কেবল মুন্সীগঞ্জ জেলায় সেরা গ্রাম নয়, হয় যেন তা একটি সেরা আদর্শ মডেল গ্রাম পুরো বাংলাদেশে ! তবেই তোমরা সত্যিকার ভাবে সফল হতে পারবে ! এবং তোমাদের নামও সেদিন ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে ! হাজার বছর পর মানুষ তোমাদের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে !”
গত শুক্রবার ২৭শে ডিসেম্বর “পূর্বশীল মান্দি ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ” পক্ষ থেকে শুরু হলো পূর্বশীলমান্দী প্রিমিয়াম লিগ (PPL) ক্রিকেট খেলা । খেলাটি শুরু হয়েছে পূর্বশীলমান্দী গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের পাশেই, পূর্বশীলমান্দী ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নিজস্ব খেলার মাঠে !
এই প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ খেলাতে যোগদান করছে মোট ৬টি টিমের সর্ব মোট ৭২ জন ক্রিকেট খেলোয়াড় । প্রতিটি টিমে থাকছে ১২ জন খেলোয়াড় ! ৬টি টিমের নাম ও ক্যাপ্টিনরা হলো যথাক্রমে: (১) আল্লাহ সর্বশক্তিমান – ক্যাপ্টিন সুমন মোল্লা (২) মায়ের দোয়া – ক্যাপ্টিন শাকিল গাজী (৩) শান্তি সংঘ – ক্যাপ্টিন রাশিদুল ইসলাম (৪) একতা সংঘ – ক্যাপ্টিন আমিনুল ইসলাম অনু (মোল্লা (৫) সুপার X I – ক্যাপ্টিন রেজাউল কাদের মিঠু এবং (৬) ইয়াং ষ্টার – ক্যাপ্টিন জসিম মোল্লা ।
পূর্বশীলমান্দী ওয়েলফেয়ার সোসাইটি প্রিমিয়ার লিগ (PPL) এর ক্রিকেট খেলা চলবে আগামী পুরো এক মাসব্যাপী । ফাইনাল খেলার দিনে হবে পুরস্কার বিতরণীর বিশেষ অনুষ্ঠান । যে অনুষ্ঠানে ঊপস্থিত থাকবে এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ । সেই অনুষ্ঠানে বিজয়ী টিমকে দেওয়া হবে বিশেষ পুরস্কার ।
পূর্বশীলমান্দি ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রিমিয়াম (PPL ) ক্রিকেট লিগ সম্পর্কে এর একজন অন্যতম সংগঠক ও ক্যাপ্টিন সুমন মোল্লা বলেন,
“আমরা সবাই মিলে পূর্বশীলমান্দি ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রিমিয়াম (PPL ) ক্রিকেট লিগ খেলা শুরু করতে পেরে আমি খুব আনন্দ অনুভব করছি ! আমাদের এই ক্রিকেট লিগ খেলার আয়োজন করার মূল কারণ হলো — আমাদের মাঝে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি করা ! সবাইকে ক্রিয়েটিভ ও ভালো কাজে ব্যাস্ত রাখা, যাতে কেউ খারাপ কাজে লিপ্ত না হয় ।”
পূর্বশীলমান্দি ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রিমিয়াম (PPL) ক্রিকেট লিগ খেলার আয়োজন দেখে আমি নিজেও খুব আনন্দ অনুভব করছি ! আমি মনে করি–
“এটি সত্যি অনেক ভালো উদ্যোগ । এতে এই খেলোয়াড়রা গ্রামে আরও ভালো ভালো কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত হবে ! গ্রামের পরিবেশ রক্ষায়, গাছ লাগানো, ফুলের বাগান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এইসব কাজে ওরা মনোযোগ দিবে । প্রতিটি ক্যাপ্টিনের মাঝে লিডারশিপ কোয়ালিটি বৃদ্ধি পাবে ! আমি ওদের এমন কাজে অনেক গর্বিত এবং “নুতন বাংলাদেশ” গঠনে, আমি তাদের মাঝে অনেক আশার আলো দেখতে পাচ্ছি! প্রিমিয়াম লিগ খেলা সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হউক সেই প্রত্যাশাই রইল!”.
পূর্বশীলমান্দি ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রিমিয়াম (PPL) ক্রিকেট লীগ এর এই ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলার সংবাদটি পুরো মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্যান্য গ্রামের মানুষের মাঝে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করবে এটা আমার ধীর বিশ্বাস !
লেখক: কলামিস্ট ও গল্পকার