কাজী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল
পটভুমিঃ জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনা অনুযায়ী প্রতিটি শিশুর প্রাপ্য হচ্ছে বিশেষ যত্ন ও সহায়তা। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ -৭(১) অনুযায়ী জন্মের সাথে সাথে শিশুর জন্মের নিবন্ধিকরণ করতে হবে। জন্মের সাথে একটি নাম,নাগরিকত্ব এবং যতদূর সম্ভব শিশুর পিতা মাতার পরিচয় জানবার অধিকার এবং তাদের কাধে প্রতিপালিত হবার অধিকার থাকবে। শিশুর অধিকার সমুন্নত ও নিশ্চিতকরণের জন্য জন্ম নিবন্ধন অতিব জরুরী। জন্ম নিবন্ধন সনদ একজন মানুষের জীবনের প্রথম দলিল। ১৮৭৩ সালের ০২ জুলাই তদানীন্তন বৃটিশ সরকার অবিভক্ত বাংলায় জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত আইন জারি করে। সেই আইনে জন্মের ০৮ দিনের মধ্যে শিশুর জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামুলক ছিল। দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে দেশের সকল মানুষ জন্ম নিবন্ধনের আওতায় না আসায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ইউনিসেফ বাংলাদেশ এর সহায়তায় পাইলট প্রকল্পে জন্ম নিবন্ধনের কাজ নতুন ভাবে শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৩ সালের আইন রদ ও রহিত করে সরকার ২০০৪ সালের ৭ ডিসেম্বর ২৯ নং আইন অথার্ৎ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ প্রবর্তন করে। আইনটি ২০০৬ সালের ০৩ জুলাই হতে কার্যকর হয়। ২০১৩ সালের ০৪ নং আইন দ্বারা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইনটি সংশোধিত হয়। বর্তমানে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ এর আলোকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮ অনুসারে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কপোর্রেশন, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড আর বিদেশ বাংলাদেশ দূতাবাস সমূহ জন্ম নিবন্ধনের দায়িত্ব পালন করে।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কি? জন্ম নিবন্ধন হলো জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ (২০০৪ সনের ২৯ নং আইন) এর আওতায় একজন মানুষের নাম, লিঙ্গ, জন্মের তারিখ ও স্থান, বাবা মায়ের নাম, তাদের জাতীয়তা এবং স্থায়ী ঠিকানা নিধার্রিত নিবন্ধক কর্তৃক রেজিস্টারে লেখা বা কম্পিউটারে এন্ট্রি প্রদান এবং জন্ম সনদ প্রদান করা। মৃত্যু নিবন্ধন হলো মৃত ব্যক্তির নাম,মৃত্যুর তারিখ, মৃত্যুর স্থান, লিঙ্গ,পিতা বা মাতা বা স্বামী অথবা স্ত্রীর নাম নিধার্রিত নিবন্ধক কর্তৃক খাতায়/রেজিস্টারে লেখা এবং মৃত্যু সনদ প্রদান করা। জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যক্তির জন্ম পরিচিতি, তবে তা নাগরিকত্ব সনদ নয়।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কি বাধ্যতামুলক?
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ এর ৮ (১) ধারা অনুয়ায়ী শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে এবং ৮ (২) ধারায় ব্যক্তির মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু নিবন্ধনের কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সকলের জন্য বাধ্যতামূলক। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে শিশুর পিতা বা মাতা বা অভিভাবক এবং ব্যক্তির বয়স ১৮ বৎসরের উর্ধ্বে হলে স্বয়ং জন্ম সংক্রান্ত তথ্য বাধ্য থাকবেন। তদ্রুপ মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত ব্যক্তির পুত্র বা কন্যা বা অভিভাবক মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য নিবন্ধকের নিকট প্রদানের জন্য বাধ্য থাকবেন। কোন ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যুর সময় উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের কেহ উপস্থিত না থাকলে সেই ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিবর্গের যে কেহ জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম বা মৃত্যুর তথ্য নিবন্ধকের নিকট প্রেরণ করিবেন।যথা:
(ক) জন্মের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভাই, বোন, পিতামহ, পিতামহী, মাতামহ বা মাতামহী এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে পিতা, মাতা, ভাই, বোন, পুত্রবধু, জামাতা, পৌত্র, পৌত্রী,দৌহিত্র বা দৌহিত্রী;
(খ) কোন প্রতিষ্ঠানে জন্ম বা মৃত্যুর ক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা তৎ কর্তৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তি।
দন্ড/শাস্তি : জন্ম নিবন্ধন ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০১৩(সংশোধনী) এর ২১ ধারার বিধান মতে এই আইনের বিধান লংঘনকারীর ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড ও এক বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
জন্ম সনদের ব্যবহার : জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ এবং জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮ অনুসারে যেসব ক্ষেত্রে জন্ম সনদ বাধ্যতামুলক করা হয়েছে :
(ক)পাসপোর্ট ইস্যু (খ) বিবাহ নিবন্ধন (গ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি (ঘ) নিয়োগ (ঙ) ড্রাইভিং লাইসেন্স (চ) ভোটার তালিকা প্রণয়ন (ছ) জমি রেজিস্ট্রেশন (জ) জাতীয় পরিচয় পত্র (ঝ) লাইফ ইন্সুরেন্স পলিসি (ঞ) ব্যাংক হিসাব খোলা (ট) আমদানি ও রপ্তানি লাইসেন্স গ্যাস,পানি, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সংযোগ (ঠ) টিআইএন ( Tin) নম্বর (ড) ঠিকাদারী লাইসেন্স (ঢ) বাড়ির নকশা অনুমোদন(ন) গাড়ির রেজিস্ট্রেশন (ত) ট্রেড লাইসেন্স (থ) টিকাদান।
যে সকল ক্ষেত্রে মৃত্যু নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে :
(ক) উত্তরাধিকার সনদ প্রাপ্তি (খ) পারিবারিক পেনশন প্রাপ্তি (গ) মৃত ব্যাক্তির লাইফ ইন্সুরেন্সের দাবি প্রাপ্তি (ঘ) নামজারি এবং জমাভাগ প্রাপ্তি।
দায়িত্ব ও কর্তব্য: নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করতে হবে। সকল সচেতন মানুষেরই দায়িত্ব নবজাত শিশুর জন্ম নিবন্ধনের জন্য শিশুর অভিভাবককে পরামর্শ প্রদান করা। যে সকল ব্যক্তি এখনো জন্ম নিবন্ধন করেননি তাদেরকে অবিলম্বে জন্ম নিবন্ধনের পরামর্শ প্রদান করা সকলের ই কর্তব্য। জন্ম নিবন্ধের পাশাপাশি মৃত্যু নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও সচেতন থাকতে হবে। যে কোন মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু নিবন্ধন করা আমাদের সকলের কর্তব্য। শুধুমাত্র জনপ্রতিনিধিগনই নয়, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা/কর্মচারী, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, মসজিদের খতিব/ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার পাদ্রী, প্যাডোগার ভিক্ষু, এনজিও কর্মী, ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের জনগনকেই এগিয়ে আসতে হবে জন্ম মৃত্যুর শতভাগ নিবন্ধন নিশ্চিত করার জন্য। সময় মত জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করলে অযথা দুভোর্গ/বিড়ম্বনা হতে অভিভাবকগন মুক্ত থাকতে পারবে।
পরিশেষে বলা যায় জন্ম একবার, নিবন্ধনও একবার নাগরিক অধিকার করতে সুরক্ষণ ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন , জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করি, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করি, তাই আসুন সময় মত আমরা আমাদের পরিবারের সকলের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নিশ্চিত করি।
লেখক: – পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা, শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা, হবিগঞ্জ।