কাজী হাসান :
আমার সংগঠক জীবনের গুরু, শ্রদ্ধেয় আশরাফ আলম কাজল ভাই ছিলেন মনেপ্রাণে একজন সংগঠক, সম্পাদক, মানবহিতৈষী। মুন্সীগঞ্জের ‘সৃজনী কচিকাঁচার মেলা’র একজন সদস্য হিসেবে ১৯৬৩ সালে তাঁর সংগঠক জীবনের যাত্রা শুরু হয়। তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। কাছাকাছি সময়ে তিনি স্কুল পর্যায়ে স্কাউটেরও সদস্য ছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে কলেজ পর্যায়ে সিলেটে প্রথম জাতীয় জাম্বুরিতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। পরের বছর কুমিল্লায় দ্বিতীয় জাতীয় জাম্বুরিতেও অংশগ্রহণ করেন। ‘কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা’র উদ্যোগে ১৯৬৫ সালে মুন্সীগঞ্জে সাতদিনব্যাপি ‘জাতীয় প্রাদেশিক শিক্ষা শিবির’ অনুষ্ঠিত হয়। যার প্রধান অতিথি ছিলেন বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদা। ওই শিবিরে অংশগ্রহণ করা ছিলো তাঁর সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ার জন্য একটি অনন্য অভিজ্ঞতা।
ক্লাশে বরাবরই তিনি প্রথম ছিলেন। ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি স্কুলে দেয়াল পত্রিকা বের করতেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ক্লাশ নাইনের ছাত্র। তাঁদের পাঠ্যসূচিতে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ ছিলো। যাতে বাঙালি সংস্কৃতিকে অনেকখানি উপেক্ষা করা হয়। যে কারণে তিনি সহপাঠীদের নিয়ে তা না পড়ার ঘোষণা দেন। করেন আন্দোলন। মূলত সে সময় থেকেই তার মনে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার বিরোধী মনোভাব শক্তভাবে দানা বাঁধে। তাঁর পিতা মোঃ ইয়াকুব আলী তালুকদার ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন মুন্সীগঞ্জস্থ এভিজেএম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। পরে স্কুলটি জাতীয়করণ করা হলে তিনি সিনিয়র শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘বিএসসি স্যার’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। মানসিকতায় তিনি ছিলেন ভীষণ প্রগতিশীল। তাঁর বড় ছেলে মোঃ কাওসার আলম তালুকদার বাম রাজনীতি করতেন। যাবতীয় অনিয়মের প্রতিবাদ ও আন্দোলনে তিনি বেশ সক্রিয় ছিলেন। যার প্রভাব আশরাফ আলম কাজল ভাইয়ের ওপরও পড়ে। তিনিও কোনও অন্যায় মেনে নিতে পারতেন না।
১৯৬৮ সালে মহকুমার ফুটবল দল ‘অ্যাপোলো ইলেভেন’ এ তিনি ১১ জনের একজন হিসেবে খেলতেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন স্বপন দাসও। যিনি মোহামেডান এর দুর্দান্ত ফুটবলার ছিলেন। স্কুল সাঁতারে তিনি জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তিনি ক্রিকেটও খেলতেন নিয়মিত। মুন্সীগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ফার্স্ট বয় ছিলেন তিনি। কে কে গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউশনের ফার্স্ট বয় ছিলেন তাঁর বন্ধু আকা ফিরোজ আহমদ। যিনি সোনারং পাইলট হাইস্কুল থেকে এসে ওই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁরা মনেপ্রাণে তখন একই মানসিকতার ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল ছিলো সে বছরের এসএসসি পরীক্ষা। যে কারণে তিনি পড়াশোনায় বেশ সময় দিতেন। ২৫ মার্চের রাতেও তিনি রুটিন মাফিক পড়েছেন। ২৬ মার্চ সকালে ছিলো থমথমে পরিবেশ। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার কথা জেনে তিনি পড়া বন্ধ করে দেন। সিদ্ধান্ত নেন সে বছর পরীক্ষা দেবেন না। তবে সহপাঠীদের অনেকেই পরীক্ষা দেয়ার বিষয়ে অটল ছিলেন। তিনি সহপাঠী মাসুদ কাদের মনাকে নিয়ে এ বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে তাঁর বড় ভাই কাওসার আলম, মিজানুর রশীদ ও আরও কয়েকজন তাঁদের বাসায় মিটিং করেন। সিদ্ধান্ত হয় পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুকদের বাসায় কাফনের কাপড়সহ চিঠি পাঠানো হবে। যাতে লেখা হয়েছিলো, যারা পরীক্ষা দেবে তাদের মেরে ফেলা হবে। পরীক্ষার দিন সকাল দশটার পরে মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুলে প্রথম গ্রেনেড ফোটানো হয়। যিনি চার্জ করেছিলেন তার নাম মিলন। শেষাবধি পরীক্ষা হলেও সে বছর সেই পরীক্ষা বাতিল করা হয়।
পরীক্ষার সময়টায় আশরাফ আলম কাজল মতলবে নানাবাড়িতে চলে যান। সেখানে তাঁর রব্বানী বাবুল মামার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কথা হয়। বাবুল মামা ছিলেন এফ এফ বাহিনীর সদস্য। তাঁর নেতৃত্বে কুমিল্লার বরুড়া পার হয়ে ওপারে যান তাঁরা। সেখানে গ্রেনেড ও বেয়নেট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। কিছু বেয়নেট ও গ্রেনেড নিয়ে মতলবের সানকিভাঙা গ্রামে মামাবাড়িতে ফিরে আসেন। তাঁরা মূলত গ্রামের পাকিস্তানি দোসরদের শায়েস্তা করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
‘ঘাস ফুল নদী’ ছিলো মুন্সীগঞ্জ শহরের দেওভোগ ভিত্তিক সংগঠন। যার নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর বন্ধু গোলাম কাদের, সমীর রায় ও সুদেব পাল। ১৯৭২ সালের ২৫ বৈশাখ এর প্রতিষ্ঠার দিন। সেদিন হাতে লেখা একটি পত্রিকা বের করা হয়। মূলতঃ পত্রিকার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘সৃজনী’ সংগঠনের ‘সৃজনী’ পত্রিকা দেখে। ঘাস ফুল নদী থেকে গোলাম কাদের এর সম্পাদনায় প্রিন্টেড পত্রিকা ‘বিস্ফোরণ’ বের হয়। বের হয় মুন্সীগঞ্জের ইতিহাস ঐতিহ্যভিত্তিক মাসিক ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘অনুসন্ধান’। ছাপা হতো নারায়ণগঞ্জের রূপসা প্রিন্টিং প্রেস থেকে। ডিজাইন করে দিতেন এখনকার বরেণ্য অভিনয় ও চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেন। ১৯৭৩ সাল থেকে তাঁর ও গোলাম কাদের এর সম্পাদনায় বের হয় ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘অনিকেত’।
সরকারী হরগঙ্গা কলেজে এইচএসসি পড়ার পরে তিনি পাড়ি জমান ঢাকায়। তিনি হরগঙ্গা কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত মহকুমা ছাত্রলীগ এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩-৭৪ সালে সয়েল সায়েন্স এ পড়াশোনা করেন। থাকেন শহীদুল্লাহ হলে। এরপরে স্নাতকোত্তরও করেন। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠন করেন ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি টুরিস্ট এসোসিয়েশন’। সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন তিনি, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সেই মাধ্যমিক পর্যায়ের বন্ধু আকা ফিরোজ আহমদ। ‘অনিকেত’ পত্রিকায় গল্পকার আতা সরকার এর লেখা ‘তিনজন মৌলভীর রমণী সংক্রান্ত আধ্যাত্মিকতা’ ছেপে ১৯৭৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয়ে ১৫ দিনের কারাবরণ করেন তিনি ও গোলাম কাদের। মুদ্রক ছিলেন গেন্ডারিয়ার ‘শাহীন প্রেস’ এর স্বত্তাধিকারী কামরুল ইসলাম। যিনি পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। পুলিশ তাঁকে সেদিন খুঁজে পায় নি।
৯০ দশকে আশরাফ আলম কাজল এর নেতৃত্বে বন্ধু চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র ও নাট্যকার কবি মাহবুব কামরান, গবেষক, লেখক মুনীর মোরশেদকে নিয়ে ৮৪ আজিজ সুপার মার্কেট এ যাত্রা শুরু করে প্রথাবিরোধী প্রকাশনা সংস্থা ‘ঘাস ফুল নদী’। যা এখন বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঋতুবৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষণাধর্মী গ্রন্থের অগ্রগণ্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।
১৯৭৮ সালে ‘ঘাস ফুল নদী’র পক্ষ থেকে তাঁরা আয়োজন করেন ‘বিক্রমপুর সুধী সমাবেশ’ এর। তাতে মুন্সীগঞ্জের সন্তানদের মধ্যে দেশ বরেণ্যগণ উপস্থিত ছিলেন। সমমনা অগ্রজ ও সমবয়সীদের নিয়ে ১৯৮০ সালের ৯ মে গঠিত হয় ‘বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’। তিনি ছিলেন সংগঠনটির ‘বোর্ড অব গভর্নরস্’ এর সদস্য। এই সংগঠনে তিনি দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য পদে থেকে সুনামের সঙ্গে কাজ করে গেছেন। তিনি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ‘বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য বিরোধী ফেডারেশন’ এর। সংগঠনটির দপ্তর সম্পাদক হিসেবে কিছু সময় আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তিনি জড়িত ছিলেন ‘বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট’ ও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন’সহ অসংখ্য সংগঠনের সঙ্গে। ছিলেন ‘ঘাস ফুল নদী’ পত্রিকার সম্পাদক ও ‘জনপ্রশাসন’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। তাঁর সংগঠন সংশ্লিষ্টতা ও দক্ষতা একটি লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। পেশাগত জীবনে আশরাফ আলম কাজল ছিলেন একজন বরেণ্য ব্যাংকার। মৃত্যুর আগেও তিনি নানা গবেষণাকর্মে ব্যস্ত থেকে অবসরযাপন করেছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর ২০২৩ সালের জন্মদিন ৩০ ডিসেম্বর বিকেলে আমাদের ‘সোনারং তরুছায়া’র ‘আলী যাকের চত্বর’ থেকে বৃক্ষপ্রেমী শিক্ষার্থীদের গাছের চারা উপহার দেয়া হয়। আমাদের ‘সোনারং তরুছায়া পাঠাগার’ এর ‘আশরাফ আলম কাজল সেকশন’ এর শুভ সূচনা হয় সেদিন থেকেই।
কাজল ভাইয়ের ওপর বই করার কথা ছিলো তাঁর জীবদ্দশায়ই, আরও কত কাজ করার ছিলো তাঁর সঙ্গে।কিন্তু তিনি ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর চলে গেলেন না ফেরার দেশে!
আর দুই মাস পরে ১৭ অক্টোবর বরেণ্য সংগঠক, সম্পাদক আশরাফ আলম কাজল ভাইয়ের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে প্রকাশ করতে যাচ্ছি তাঁর ওপর তাঁর জীবদ্দশায় কাজ শুরু হওয়া সেই বইটি। যে বইটি হতে পারতো একটি উচ্ছ্বাসময় শুভেচ্ছা গ্রন্থ, এখন হতে যাচ্ছে স্মারক গ্রন্থ!
.