ফারুক আহমেদ: রমজান হলো মুসলমানদের জন্য রহমতের মাস, মহান আল্লাহর করুণার মাস। এই রমজান মাসে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মাফ করার ইচ্ছে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়।
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “রমজান মাস আসলে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।” (সহিহ বুখারি: ১৮৯৯, সহিহ মুসলিম: ১০৭৯)
এই হাদিসটিতে রমজানের মহিমা ও করুণার প্রকাশ পায়। অর্থাৎ, এই মাসে আল্লাহর রহমত ও মাফ করার সম্ভাবনা সর্বাধিক থাকে। মুসলমানরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের পাপের জন্য তওবা করে, পরিশুদ্ধ জীবনের পথে পা বাড়ার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে !
রমজান কেবল রোজা রাখার মাস নয়, বরং এটি আল্লাহর করুণা, ক্ষমা এবং আত্মশুদ্ধির মাস। কোরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই মাসে তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আমরা পাপ থেকে দূরে থেকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারি।
রমজান হলো মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধির এক মহিমান্বিত মাস। এই মাসে মহান আল্লাহ আমাদের জন্য সিয়াম বা রোজা ফরজ করেছেন।
রোজা হলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরনের পানাহার, কামাচার ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার এক মহান ইবাদত।
কিন্তু শুধু খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকাই রোজার মূল লক্ষ্য নয়। বরং এর মাধ্যমে আমাদের আত্মাকে সংযত করা, লোভ-লালসা থেকে মুক্ত রাখা এবং চরিত্রকে পবিত্র করাই রোজার আসল শিক্ষা। তাই রমজান হলো আত্মশুদ্ধির মাস।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সুরা আল-বাকারা: ১৮৩)
তাকওয়া হলো আল্লাহভীতি, যা মানুষকে সকল প্রকার পাপ ও খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। রোজার মাধ্যমে এই তাকওয়া অর্জিত হয়, যা মানুষের আত্মাকে শুদ্ধ করে।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (৬০৫৭) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৭৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৭৭৯)
অর্থাৎ, রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করা নয়, বরং সকল প্রকার অন্যায় ও পাপাচার থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
রোজা কীভাবে আত্মশুদ্ধির কাজ করে ?
রোজা আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং আমাদের খারাপ অভ্যাসগুলো পরিবর্তনের সুযোগ দেয়। এই মাসে আমরা সংযম ও ধৈর্যের চর্চা করি, যা আমাদের নৈতিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য।
রোজার মাধ্যমে আমাদের অর্জন :
১. নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি: রোজা আমাদের ধৈর্য ধরতে শেখায়, যা আমাদের আত্মাকে সংযত রাখে এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে।
২. আল্লার ভয় সৃষ্টি করে: একজন মানুষ রোজা রাখার পর, কেবল মাত্র আল্লার ভয়ে সে চুপি চুপি আহার গ্রহণ করে না। রোজার মাধ্যমে যদি কোন মানুষের মনে আল্লার ভয় সৃষ্টি তৈরি করতে পারে, তাহলে ব্যাক্তিজীবনে সে আল্লার ভয়ে কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না।
৩. লোভ-লালসা দূর করে : রোজার সময় আমরা বুঝতে পারি, আমাদের প্রয়োজন খুব সামান্য, অপ্রয়োজনীয় বস্তু বা অর্থের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া অর্থহীন।
৪. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন গড়তে শিখি: রোজা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, আসল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
এই ব্যাপারে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন — ‘সে-ই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে; এবং সে-ই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষিত করবে।’ (সুরা শামস: ৯-১০)
লোভ-লালসার ক্ষতিকর দিক:
১. চরিত্রকে ধ্বংস করা: লোভ-লালসা মানুষের চরিত্রকে ধ্বংস করে, নৈতিকতাকে কলুষিত করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
২. লোভের বসবর্তী হওয়া: অনেক মানুষ অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ করে, অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে, ঘুষ, দুর্নীতি ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়।
৩. অস্থিরতা ও অসন্তোষ: লোভী মানুষ কখনো সন্তুষ্ট থাকতে পারে না, সবসময় বেশি পাওয়ার চিন্তায় অস্থির থাকে।
৪. মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো: লোভ মানুষকে ধোঁকাবাজ ও প্রতারক করে তোলে, যার ফলে অন্যের বিশ্বাস নষ্ট হয়।
৫. হারাম উপার্জনের দিকে ধাবিত হওয়া: লোভী ব্যক্তি সহজ উপায়ে অর্থ উপার্জনের জন্য দুর্নীতি ও প্রতারণার পথ বেছে নেয়, যা তার দুনিয়া ও আখিরাতকে ধ্বংস করে।
অথচ আল্লাহ পবিত্র কোরানে ইরশাদ করেছেন, “আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের কাছে পেশ করো না।(সুরা আল-বাকারা: ১৮৮)।
এখানে মহান আল্লাহ পরিষ্কার ভাবে বলে দিয়েছেন, কেউ যাতে একে অন্যের সম্পদ অন্যায় ভাবে আত্মসাৎ না করেন, ভোগ না করেন এবং বিচারকদের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে সেই সম্পদ নিজের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না করেন । হারাম সম্পদ হারাম হিসেবেই থাকবে ।
রোজার আত্মশুদ্ধির শিক্ষা আমাদের নিজেদের পরিবর্তন করার শিক্ষা দেয় তা হলো:
১. অন্যের সম্পদে লোভ না করা: রোজার মাধ্যমে সংযম অনুশীলন করতে হবে এবং পরের সম্পদের প্রতি লোভ না করে নিজের অর্জনে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
২. সাদাকা ও দান করা: দান-সাদাকা লোভ দূর করে এবং আত্মাকে পবিত্র করে।
৩. হালাল রিজিক উপার্জন করা: পরিশ্রম ও হালাল পথে উপার্জন করলে জীবনে বরকত আসে এবং মানুষ আত্মিক শান্তি লাভ করে।
৪. পরমতসহিষ্ণুতা চর্চা করা: অন্যের সাফল্যে ঈর্ষা না করে কৃতজ্ঞ থাকা ও নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত।
একটি শিক্ষণীয় ছোট গল্প:
হোসেন নামের এক কৃষক গ্রামে বসবাস করত । যিনি নিজের জমি চাষবাস করে গ্রামে খুব ভালো অবস্থানে বাস করছিলেন । তার কর্মঠতা ও সততা গ্রামে সবার কাছে পরিচিত ছিল।
কিন্তু ধীরে ধীরে তার মনে লোভ জন্মাতে লাগল – এবং তার মনে দ্রুত ও সহজ পথে বড়োলোক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলো ! সে আপন ভাই বোনদের সম্পত্তি বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ করতে লাগল । সেই সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য এলাকার মাদবরদের ঘুষ দিতে লাগল, স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে রাখতে শুরু করল । নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য এলাকায় মসজিদ – মাদ্রাসাতে দান করতে লাগল ।
হোসেনের লোভ আরও অনেক বেড়ে গেল ! একদিন হোসেন সেই গ্রামের এক প্রখ্যাত মাদক ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করল । ব্যবসায়ী তাকে বলল, “তুমি যদি আমার সঙ্গে যুক্ত হও এবং আমাকে টাকা দিয়ে ব্যবসার পার্টনার হও , তাহলে তুমি খুব তাড়াতাড়ি আরো অনেক বেশি টাকা পাবে এবং পুরো এলাকায় তুমি এক নাম্বার ধনী হতে পারবে।”
লোভী হোসেন তার জমানো সমস্ত টাকা ওই মাদক ব্যবসায় বিনিয়োগ করল । প্রথমদিকে সে কিছু লাভ পেতে থাকল, যা তার আশা ও তৃপ্তিকে আরও বাড়িয়ে দিল।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ! একদিন হঠাৎ পুলিশ গ্রামে প্রবেশ করল। তারা হোসেনসহ মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের সকল অবৈধ মাদক ব্যবসার মালামাল নিয়ে গেল !
আদাল হোসেন সহ মাদক ব্যাবসায়ীকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করল ! জেলে কাটানো দিনগুলোতে হোসেনের মন ও হৃদয় ভীষণ ভাবে ভেঙে গেল। সেই সময়ে রমজান মাস আসে, হোসেন মাহে রমজানের শিক্ষা আত্মশুদ্ধির দীক্ষা পেল ! রমজান মাসের আত্মশুদ্ধি তাকে নতুন করে ভাবতে শেখালো। রমজানের মহিমা, তওবা ও আল্লাহর করুণার প্রতিচ্ছবি হোসেনের হৃদয়ে আশার আলো জ্বালিয়ে দিল।
জেল থেকে ছুটে বের হওয়ার পর, হোসেনের মনে পরিবর্তনের সঞ্চার হলো ! সে উপলব্ধি করল যে, লোভে পড়ে সে নিজেকে, তার পরিবার ও গ্রামের সম্মান হারিয়ে ফেলেছে !
সে শপথ করল, সে আর কখনোই লোভে পড়ে অন্যায় পথে যাবেনা। যাদের কাছ থেকে এতদিন ক্ষমতার জোরে ভাই বোন সহ অন্যদের যে সকল অর্থ ও সম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, সে তাদের তা ফিরিয়ে দিল, সবার কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল । ক্ষমতার জোরে মানুষের সাথে খারাপ আচরণের জন্য সে সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল ।
গ্রামে ফিরে হোসেন নতুন উদ্যমে কঠোর পরিশ্রম শুরু করল। সে সততার পথে ফিরে গিয়ে এবং গ্রামের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ও সেবার হাত বাড়িয়ে দিল ! রমজানের শিক্ষায় প্রেরণা নিয়ে হোসেন নিজের জীবনে ও সমাজে সঠিক ও ন্যায়পরায়ণতার প্রতিষ্ঠা করতে চলল!
এইভাবে, হোসেনের আত্মসংশোধন প্রমাণ করল যে, জীবনের প্রতিটি ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিণতি বদলে যাওয়া সম্ভব – বিশেষ করে রমজানের পবিত্র মাসে, যখন আল্লাহর রহমত ও করুণা সর্বাধিক বিস্তৃত থাকে।
রমজান আমাদের শুধু রোজা রাখার জন্য নয়, বরং আত্মশুদ্ধির জন্য এক অসাধারণ সুযোগ এনে দেয়। এই মাস আমাদের শেখায় সংযম, ধৈর্য, লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকা এবং আত্মাকে পবিত্র করা।
আসুন, আমরা এই রমজানে নিজেদের পরিবর্তন করি। অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ না করে, হালাল পথে উপার্জন করে, দানশীলতা ও কৃতজ্ঞতার অভ্যাস গড়ে তুলি। তাহলে আমরা সত্যিকারের আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পারব এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে সক্ষম হব।আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের তৌফিক দান করুন।
আমিন।