রবিবার , ১৮ মে ২০২৫ | ৩১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ
  3. অর্থনীতি
  4. আইন-আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. আরো
  7. এক্সক্লুসিভ নিউজ
  8. কলাম
  9. কৃষি
  10. খুলনা বিভাগ
  11. খেলাধুলা
  12. গজারিয়া
  13. গণমাধ্যম
  14. চট্টগ্রাম বিভাগ
  15. জাতীয়

মেধাবী ছাত্র থেকে তপস্বী ! তিনি ছিলেন উদ্ভিদ তপস্বী , একজন লোকজ্ঞান সংগ্রহক , অ-একাদেমিক বিজ্ঞানী

প্রতিবেদক
সভ্যতার আলো ডেস্ক
মে ১৮, ২০২৫ ৩:১৮ অপরাহ্ণ

সাজাহান সরদার 
মুন্সীগঞ্জ শহরের জুবলিখাল ভরাট হওয়ার দুই দশক আগের চিত্র । মাউছা বাজারের পূবদিকে জুবলি খালের ওপরে পূব-পশ্চিম মুখি একটি কাঠের সেতু ছিল । ওই সেতু পার হয়ে পূব পাড় এলে বাঁয়ে গেলে প্রথমে একটি বেশ্যা বাড়ি তারপর মেথর পট্টি । ডানে খালইস্ট পাড়া , খালের পাড় ধরে পায়ে চলার সরু কাঁচা রাস্তা । সোজা হেঁটে গেলে মাঠপাড়া-কাচারী  কাঠের  পোল ।   খালইস্টের রাস্তার শুরুতে একটা টিনের চালা ঘর । ঘরের বেড়ায় একটা সাইনবোর্ড , তাতে বড় হরফে ‘হেকিম মো: হাতিম‘ লেখা । ছেলে বেলায় ওই পথে যেতে লেখাটা বার বার পড়েছি । হেকিম শব্দটি তখন পাঠ্য বইয়ের সূত্রে পরিচিত , আবার দাতা হাতিমের গল্পও পাঠ করেছি । দুইটি শব্দই আমার কাছে সমিহ অর্জন করেছিল । সাইনবোর্ডের হাতিম কোনটি তা মিলাতে পারিনি। হেকিম-ই হোক আর দাতা হাতিম-ই হোক দুই আমার কাছে অত্যন্ত সন্মানিত
ব্যক্তি । হেকিম হাতেম আলীকে কখনো চোখে দেখিনি কিন্তু এই নাম ছোটবেলায়-ই ভেতরে প্রথিত হয়ে
যায় । যখন মুন্সীগনজ হাই স্কুলের  ছাত্র ছিলাম তখন তাঁর দুই ছেলে আমার সমসাময়িক ছিলেন । বড় ছেলে হোসেন ভাই আমার দুই ক্লাস উপরে পড়তেন । তিনি ছিলেন গৌরবর্ণ , সুদর্শন , পরিপাটি ,  মেধা বৃত্তি পাওয়া তুখোর মেধাবী , তারকা ছাত্র । ছিলেন শান্তশিস্ট ভাল ছেলে ।
 আমি ওই নক্ষত্র দর্শন করেছি দূর থেকে । তাঁর সহোদর শহীদুল্লাহ আমার সহপাঠি ছিল । সহপাঠি শহীদুল্লাহর সাথে আমার বন্ধুত্ব কিংবা আড্ডার সম্পর্ক ছিলনা। স্কুল পাশ করে ঢাকা এবং বিদেশ কেন্দ্রীক শিক্ষা আর জীবিকায় দীর্ঘ সময় মুন্সীগঞ্জ বিচ্ছিন্ন থাকি । তিন দশক পরে যখন মুন্সীগঞ্জ মুখী হই তখন অনেক বদলে গেছে প্রিয় শহর গ্রাম । শহরের ধমনী জুবলি খালের কবর রচিত হয়েছে , নিশ্চিহ্ন অনেক পুকুর ডোবা ,  ফসলের মাঠ মানিকপুর চক নিরুদেশ  , গাছগাছালির সবুজ সামিয়ানার নিচের মনোহর টিনের চালা ঘরগুলি উধাও !
ঢাকার জীবনকে সাময়িক গুডবাই বলে পৈতৃক বাড়ি “ নিসর্গ আঙ্গন “ এসে বছর কয়েক নির্জন
বাস করি ! সেই  সময় একদিন
হোসেন ভাই আমার সাথে দেখা
করেন । অনেক বছর পর হলেও
আমি তাঁকে চিনতে পারি ।  তাঁর
পরিধেয় মলিন , ভগ্ন ক্ষয়িষ্ণু শরীর , দুস্থতা প্রকট , অকাল বৃদ্ধ ।আমি বিস্মিত , হতভম্ব । একদা রাজপুত্রের মতো হোসেন ভাইকে এই রকম নিস্ব: উদভ্রান্ত দেখে । তাঁকে বৈঠকখানায় ডেকে  বসতে দেই , আপ্যায়ন  করি । তিনি আপ্যায়ন বিমুখ । আমি দ্বিধান্বিত । কি কথা বলি তাঁর সাথে ! আমার সাথে তাঁর কখনো তেমন সংঙ্গ ছিলনা , ছিল অন্তস্থলের নির্বাক
শ্রদ্ধা । তাঁর বর্তমান  ম্লান জীবন
নিয়ে কোন প্রশ্ন করা থেকে বিরত রইলাম পাছে তিনি বিব্রত হোন ।
আমি বরং স্মৃতিচারণ করলাম ,
তাঁর রূপ ও গুণের প্রসংশা করলাম । অপেক্ষা করলাম তাঁর প্রতিক্রিয়া শুনার জন্য । না , তিনি নিজের প্রসংসা শুনে আপ্লুত হইলেন না , নিজের অভাব অনটনের কথা বললেন না , আমার স্তুতিও করলেন না । হোসেন ভাই আমার পিতা আলম সরদার সাহেবের বৃক্ষ প্রীতির কথা বললেন , আমাদের বাড়িখানির অরন্য রূপের বর্নণা দিলেন , ওষধি গাছ-গাছালির ক্রমবর্ধমান বিলুপ্তির কথা বললেন , লোকায়ত চিকিৎসা কবিরাজী , হেকিমি , আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার গুরুত্বের কথা বললেন ।অতপর: আবার আসবেন বলে বিদায়
নিলেন ।
 এরপর থেকে প্রায়শ:ই তিনি নিসর্গ অঙ্গনে আসেন, গাছগাছালীর ঔষুধিগুণ নিয়ে কথা বলেন, কথা বলেন তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে । আমি তাঁকে প্রশ্ন করি , সারাদিন কোথায় ছিলেন ? জবাব দেন , লতা-গুল্ম গাছগাছালির খোঁজে গ্রামে গ্রামে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন  । ওষুধি গাছ সনাক্ত করা , নমুনা সংগ্রহ ,  পরীক্ষা-নিরীক্ষা-চিকিৎসার প্রয়োজনে কিছু সংগ্রহ , এই করে দিন দিন গরিয়ে
গেছে । – আহার করেছেন ? তিনি নিরুত্তর থাকেন । আমি তাঁর জন্য খাবার আনতে বলি তিনি দ্রুত প্রস্থান করেন ।
কোনো কোনো দিন আমাকে ছোট ছোট কবিরাজি/হেকিমি পুটলি দেন, পয়সা নেন না । পথে ঘাটে দেখা হয়, সালাম দেন, ইঙ্গিতে কুশল বিনিময় করেন, কথা হয় না তেমন ।
আমি প্রাত: ভ্রমন করি গ্রামের পথে ।এক সকালে তাঁকে দেখি রতনপুর
গ্রামের   ঝোঁপ-জঙ্গলে কি যেন খুঁজছেন । লতা-পাতা-গাছের ছাল-বাকলের গন্ধ শুকছেন , স্বাদ পরোখ
করছেন । আমি তাঁর সন্মুখে দাঁড়াইনা তপস্বা ভঙ্গ হবে বলে ।
তাঁর সাথে কথোপকথনে তাঁর বর্তমান হাল এমন কেন কিংবা তাঁর ঘরসংসার সম্পর্কে কখনো কোনো প্রশ্ন করি নাই । তাঁকে আমার সারাক্ষণ ধ্যানমগ্ন মনে হতো, তাই তা ভঙ্গ করা অনৈতিক মনে হয়েছে । তাঁর গৃহস্থ জীবন কিংবা ভব সংসার সম্পর্কে কিছুই  জানিনা । শুধু জানি এমন তপস্বীর জাগতিক কিছু থাকতে নেই ।
প্রবাস থেকে জেনেছি তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে গেছেন  ( ২৫ মে ২০২১ ) । আফসোস , হতভাগ্য শহরবাসী জানলো না তিনি ছিলেন তাদের কল্যাণে নিবেদিত একজন উদ্ভিদ তপস্বী , একজন লোকজ্ঞান সংগ্রহক , অ-একাদেমিক বিজ্ঞানী ।

সর্বশেষ - মুন্সীগঞ্জ