আতিকুর রহমান টিপু : শেখ আলী আকবর একজন সংগ্রামী মানুষ।।কজন প্রকৃত জীবন যোদ্ধা। দারিদ্র আর কষ্টের ভেতরও যিনি সাধনাকে ছেড়ে কক্ষচ্যুত হননি। জীবনের প্রায় ৬৫টি বছর যার লেখা লেখির ভেতর কেটেছে। কখনো পাখির ডাক আর কখনো ফিঙের ডানা ঝাপটানী তাকে বিমুগ্ধ করেছে। প্রকৃতির সাথে যার আত্মীয়তার বন্ধন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তার ক্ষুরধার কলম চলেছে সমাজ ও প্রকৃতির আমুল পরিবর্তনের তাগিদে। কখনো সারাদিন জোটেনি খাবার। থেকেছেন ভাড়া বাড়িতে কিন্তু লেখা লেখি কখনো থামেনি। বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমের আলোতে চলেছে তার লেখনী। যেনো ভিন্ন ধাচের এক কলম যোদ্ধা। কি লিখেছেন তিনি সারা জীবন? গল্প, কবিতা, ছড়া, পুঁথি আর গীতিকবিতা। সাথে সাংবাদিকতাতো আছেই।
সাংবাদিকতা জীবনে প্রায় ১০ থেকে ১২টি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। সেই দৈনিক আযাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, সমাচার, দৈনিক সবুজ দেশ থেকে আরম্ভ করে প্রচুর পত্রিকায় কাজ করেছেন শেখ আলী আকবর । নিজের মুখেই সবগুলো পত্রিকার কথা বলেছেন তিনি। সেই ফজরের নামাজ শেষ করে আহার না করেই ছুটতেন বাসা থেকে। সাথে একটি ব্যাগ ও পুরনো একটি ক্যামেরা ছিল তার সঙ্গী। কলম রাখতে কখনোই ভুল করতেন না। চলার পথে মনের ভেতর যে আবেগ আসতো তা বন্দী করে নিতেন। প্রকৃতিতে বিমুগ্ধ হয়ে লিখতেন ছড়া। কখনো কবিতা আবার কখনো ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক শব্দে বন্দী করতেন স্থিরচিত্র। তার বাসায় যখন যেতাম দেখতাম বিশাল পান্ডুলিপি । কোনটি কবিতার, কোনটি ছড়ার, কোনটি গীতিকবিতার আবার কোনটি পুঁথির। জিজ্ঞেস করতাম কোনো পান্ডুলিপি ছাপাচ্ছেন না? উত্তরে বলতেন টাকা পয়সা নেই। তাই ছাপানো যাচ্ছেনা। কখনো বলেছেন প্রকাশকরা পয়সা ছাড়া ছাপাবে? মন খারাপ হবার কথা। কিন্তু না, সতেজ ছিলো তার মন, প্রবল ছিল তা মানসিকতা। আশা একদিন তার লেখা অনেকগুলো বই হবে। সেই আশায়ই বুক বাধতেন। তার জীবনের প্রায় ৮০টি বছর কাটিয়েছেন বেশ কটি ভাগে।
কৈশোর কালের কিছু সময় নিজ উপজেলা সিরাজদিখানের কাঁঠালতলী গ্রামে। কিছু সময় চট্টগ্রামে, কিছু সময় রংপুর। বাকী সময় মুন্সীগঞ্জ শহর ও আশ পাশ এলাকায়। নিজে চয়নিকা নামে একটি সাময়িকী অনেকদিন সম্পাদনা করেছেন। ইমদাদুল হক পলাশ সম্পাদিত মাসিক বিক্রমপুরের ছিলেন নিয়মিত কলম যোদ্ধা। সাপ্তাহিক খোলা কাগজের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে বেশ সময় পার করেছেন। নানা সংগঠনের সাথেও ছিলেন সম্পৃৃক্ত। শিশু-কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন অনেক সময় ধরে। খসনুর আলমগীরের অনুপ্রাসের মুন্সীগঞ্জ জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু পর্যন্ত। শেষের দিকে দৈনিক আজকের বসুন্ধরায় জেলার সম্মানজনক দায়িত্বে ছিলেন।
তিনি মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের ৩ বার সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার সাথে আমার পরিচয় সম্ভবত ১৯৯৬ সালের প্রথম দিকে। আমি তখন মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সদস্য। তিনিও সদস্য হয়েছেন। মুখভরা সাদা দাঁড়ি এবং অনেকটা বয়োঃবৃদ্ধ। বেশ শান্তশিষ্ট ও পরিশ্রমী এবং বিচক্ষণ মনে হলো তাকে। তার সাথে আস্তে আস্তে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। আমাকে তিনি শ্বশুর বলে ডাকতেন। এরও একটি কাহিনী রয়েছে।
তিনি যখন ৫ম শ্রেণীতে পড়েন তখন প্রায় সময় পড়া-লেখা বন্ধ করে প্রকৃতির সাথে মিশে যেতেন। এসব তার পিতা শেখ ওয়াজউদ্দিন ভালো চোখে দেখতেন না। পড়াশুনায় কম নম্বর পেয়ে কাউকে না বলে ভয়ে চলে যান গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রাম। পালিয়ে যাওয়ার পর তিনি কিছু সময় বেশ কষ্ট করেন। পরে হকারী করেন। কখনো দোকানে কাজ করেন। এর ফাঁকে পড়াশুনা চালিয়ে যান এবং এক সময় পড়াশুনা শেষ করেন। এরই মাঝে চলতে থাকে তার লেখা-লেখি। যাকে একবার লেখা-লেখির নেশায় পেয়ে যায় তাকে ফেরায় কে? তিনি তো বসন্ত ফেরারী। এক সময় রংপুরে বিয়ে করেন। দুটি সন্তানেরও পিতা হন। কিন্তু তার লেখা-লেখির নেশার কারণে কোন কাজেই মন বসেনি। ফলে কমে যায় তার আয় উন্নতি। তীব্র অভাব দেখা দেয় সংসারে। ফলে স্ত্রী তাকে ও তার দুটি সন্তান রেখে সংসার ছাড়েন। তিনি উপায় না পেয়ে চলে আসেন নিজ গ্রামে। এসেই আবার লেখা-লেখিতে সম্পৃক্ত হন।
এরপর চলে আসেন-মুন্সীগঞ্জ শহরে। শহর ও তার আশে-পাশে এলাকার তার জীবনের বাকী সময়গুলো কাটান। একমাত্র লেখা-লেখি ও সাংবাদিকতাকেই নেশা ও পেশা হিসেবে বেছে নেন। প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদের প্রায় দেড় দশক পরে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেই বিয়ের উকিল হিসেবে আমাকে রাখেন বিধায় আমি হয়ে যাই উকিল শ্বশুর। মানুষটিকে যতই দেখেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি। যখন তার বয়স প্রায় ৭৭ তখনও লিখছেন দিনরাত। পত্রিকায় সংবাদ পাঠাচ্ছেন। চয়নিকা সম্পাদনা করছেন। কিন্তু বয়স তাকে যেনো হার মানাতে পারেনি। যখন তিনি হাটতেন তখন ধীরে ধীরে পা ফেলতেন। অর্থ সংকটের কারণে রিক্সা ও অটোতে চলতেন কম। চলাফেরায় ছিলো তার সতর্ক দৃষ্টি। মানুষ তাকে লেখক যেমন ভাবতো আবার চারণ সাংবাদিক হিসেবেও মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেন। তার জীবনটা কেটেছে অভাব আর অনটনের সাথে যুদ্ধ করে। এই অকুতোভয় কলম যোদ্ধার সারাজীবনের লেখা-লেখি নাকি তার অর্জন। স্থানীয় পত্রিকা, মাসিক, সাময়িকীসহ নানা জায়গায় তার অসংখ্য লেখা ছাপানো হয়েছে।
তিনি একজন সৎ ও সাহসী কলম যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার মৃত্যুটা ও ছিলো আশ্বর্যজনক। ২৪শে মার্চ ২০২১ সাল। তিনি তার মুন্সীগঞ্জ শহরের ইসলামপুরের ভাড়া বাসা থেকে বিকেল বেলা বের হন। বের হয়ে তিনি সরকারী হরগঙ্গা কলেজের সামনে কাজী বিপ্লবের দোকানের কাছে আসার পর অসুস্থতা বোধ করেন। কয়েকদিন আগ থেকেই তার ঠান্ডাজনিত সমস্যা ছিলো। সংবাদ পেয়ে তাকে সাংবাদিক লিটনসহ বেশ কয়েকজন মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তখন সময় সন্ধ্যা। ঠিক মাগরিবের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছিলো। ঠিক তখন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কলম যোদ্ধা শেখ আলী আকবর সাহেব।
মৃত্যুর ১০ থেকে ১৫ দিন পর আমি তার সারা জীবনের অর্জন পান্ডুলিপিগুলো সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলাম তার ভাড়া বাসায়। তার স্ত্রী জানালেন ২দিন আগে সব ভাঙারীর কাছে কেজি দরে বেচে দিয়েছেন। মাথায় হাত রাখলাম। অস্বস্তি তাড়া করলো বুঝলামনা কি হলো। তার পরেও নানা পত্রিকায় ম্যাগাজিনে যা ছাপা হয়েছে তা কম নয়। যদি সংগ্রহ করে ছাপা যায় বা কোন হৃদয়বান ব্যক্তি এগিয়ে আসেন তাহলে আলোর মুখ দেখতে পেতো তার নিরলস সাধনা। সিরাজদিখানের কাঁঠালতলী গ্রামের একজন শেখ আলী আকবর কিছুটা হলেও বেঁচে থাকতেন আমাদের মাঝে।