সাজাহান সরদার
খু্ বছোটবেলা থেকেই আমার সঙ্গ কাতরতা ছিল । পরিবারিক বাধার প্রাচীর ছিল তবু সঙ্গ পেতে মরিয়া ছিলাম ।
শৈশব- কৈশোরে আমাদের বাড়িটা ছিল নিরাক , সঙ্গ ও সঙ্গী বিহীন
জঙ্গল বাড়ি । উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত
বাড়ির তিন ধার ছিল জলাশয় ঘেরা । সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল বাড়ির দক্ষিণ-পূবে জলাশয়ের পাড় থেকে উপরে অনেকখানি জমি জুড়ে আদিম এক নিছিদ্র জঙ্গগল । হিজল , বরুন , বেত , কাঁটা-ঝোঁপের জঙ্গল । ওই তলাটে ডাঙ্গার বাসিন্দা ছিল খাটাস , শিয়াল , বেড়াল , পেঁচা ! জলার বাসিন্দা ছিল উদ বিড়াল । কচ্ছপ ,
সাপ-খোপ , ভূত-পেত্নী ছিল উভয় চর । ভয় ও বিস্বাদে ভরা ওই বাড়ির সীমানার বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল । নিষেধ ছিল
ওই ঝোঁপ-জঙ্গলে আপন মনে অভিযান করা । আরও নানা রকম নিষেধ ছিল । ঘুড়ি উড়ানো , পুকুরে নেমে ডুব খেলা , বৃষ্টিতে ভেজা , ছিপ দিয়ে মাছ ধরা , ছাড়াবাড়ি গিয়ে গ্রাম্য উদোম নাবালকদের সঙ্গে গলাগলি করা -এই সব দন্ডনীয় অপরাধ ছিল । আনন্দ ছিল কলের গান শোনা , মায়ের সঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে বাইস্কোপ দেখা এবং মেঝ খালাম্মাদের গোয়াল পাড়ার বাসায় বেড়াতে যাওয়া । গোয়াল পাড়া নিয়মিত যাওয়ার আরেকটা সুযোগ তৈরী হয় ধোপা মাস্টারের পাঠশালায় নাম লিখানোর সুবাদে।
মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি ও পাঠশালা ছিল গোয়ালপাড়া, মেঝ খালাম্মার বাড়ি লাগোয়া ।
পাঠশালায় দুই চার দিন বাবা-মা নিয়ে গেলেও তারপর স্বাধীন ভাবে আসা-যাওয়া করেছি । বর্ষায় যেতাম শহরের পাকা পথে এবং শুকনা সময় যেতাম মানিকপুরের জমির আল পথে ।
যে-সময়ের কথা বলছি তখন শহরের উত্তর -পশ্চিমের এক ব্রত্য জনপদের নাম ছিল গোয়াল পাড়া , কাগজপত্রের নাম বাগমাহমুদ আলী । গোয়াল পাড়া জনবসতি রূপে গড়ে উঠেছিল বৃটিশ আমলে , যখন মোগল দূর্গ নগরী ইদ্রাকপুর নতুন নামে মুন্সীগঞ্জ মহকুমা সদর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ।
সদরের গোয়াল পাড়ায় সবার আগে
আসে উচ্চবর্ণের চ্যাটার্জী ব্যানার্জি, মিত্র , গুহ , গুপ্তগণ । তাঁরা আসেন গ্রামীন অভিজাত পরিবার থেকে , সদর কেন্দ্রিক এলিট জীবন-জীবিকার হাতছানিতে ।
এই এলিট শ্রেণীর পেশা ছিল ওকালতি , মোক্তারি , ডাক্তারি , সরকারি চাকুরী , ইত্যাদি । গোয়াল পাড়ার কিছু পুরনো দালান ঘর সেই সাক্ষী বহন করে । তারপর ধীরে ধীরে আসে সাপোর্টিং কমিউনিটি নিম্নবর্ণের বেনিয়া সম্প্রদায় সাউ ( সাহা ) , জেলে , ঘোষ , গোয়াল , ধোপা , নাপিত , পোদ্দার , সোনারুগণ । ষাট-সত্তর দশকে এইখানে সাউপাড়া ছিল , জাউল্লা বাড়ি ছিল , পাল বাড়ি ছিল ( পাল – কুমার ) , ছিল ভেউল্লা বাড়ি ( ভেল দিয়ে মাছ শিকারী জেলেদের ভেউল্লা নামে ডাকা হতো) । সংখ্যায় জাউল্লা-ভাউল্লারা বেশী ছিল । সাউরা ছিল একক সংখ্যা গরিষ্ঠ সমপ্রদায় । তবু মহল্লার নাম কেন যে গোয়ালপাড়া হলো তা আমার বুঝে আসেনা । ১৯৪৭ এর আগে ও পরে অভিজাত এবং বিত্তবানগণ অনেকেই ভারত পাড়ি জমিয়েছেন । জিতেন মুখার্জি তো গেলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার এক যুগ পরে । সম্ভবত গোয়াল পাড়ায় শেষ ব্রাহ্মণ বাতি জ্বালিয়ে আছে আমার শৈশব-বাল্য কালের দোস্ত ছোটকা পোশাকী নাম কমল বানার্জী । ছোটকার সঙ্গে আমার গলাগলি ভাব পাঠশালা থেকে শুরু । মেঝ খালাম্মাদের বাসা কিংবা পাঠশালায় আসা-যাওয়ার পথ
ছিল ছোটকাদের বাড়ির সন্মুখ দিয়ে । বাড়ির সামনে পূবমুখি ছিল ওদের সাবেকী আমলের দোতালা দালান ঘর। ওই ঘরের নিচ তলায় প্রায় সময়ই গান-বাজনা
হতো । আমি মাঝে মাঝে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতাম একজন হারমনিয়া বাজিয়ে গান গাইছে অন্যজন তবলা ঠুকছে । ওই গান এবং বাজনা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম । বুঝ বয়সে দেখেছি গান গাইছে ছোটকার বড় দা
দীপক বানার্জী কিংবা বোন বীনাদি এবং তবলা বাজাচ্ছে আমার দোস্ত ছোটকা কিংবা দীপক দা ।ছোটকার মেঝ ভাই মাইজাও ( প্রদীপ বানার্জী ) তবলা
বাজাত । ছোটকাদের পুরো পরিবারই
গান-বাজনা করতো । তরুন বয়সে দেখেছি ছোটকাদের বাড়িতে নিয়মিত গানের জলশা । ওই জলশার নিয়মিত অতিথি ছিলেন হরগঙ্গা কলেজের তরুন অধ্যাপক জয়ন্ত সন্যাল , অনিল কুমার চক্রবর্তী , অধ্যাপক মোহসিন , সুর্নিমল চক্রবর্তী , প্রমুখ ।
মেঝো খালাম্মাদের বাড়িতে আসা-যাওয়ার সুবাদে গোয়াল পাড়ার সাথে আমার প্রগাঢ় সম্পর্ক তৈরী হয় । সমবয়সী , সহপাঠী এমনকি বড়দের সংঙ্গে তৈরী হয় বন্ধুত্ব ।
বন্ধু তালিকা দীর্ঘ হলেও খালাত ভাই লুৎফর রহমান শিকদার ( বাবু ) , লুৎফর রহমান চৌধুরী ( খোকা ) , খায়রুল কবির ( স্বপ্ন ) , যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ঝিন্না , কবির , প্রয়াত আল মাসুদ , প্রদীপ বানার্জী , নিঁখোঁজ গাজী , আর্টিস্ট সেন্টু দা , পিরু দা , মাখন দা , ফ্রান্স প্রবাসী কাজী জাহাঙ্গীর ( জামাত ) , কালা ঘোষ , সত্য ঘোষ , সুধাংশু , বিষু ঘোষ ( টেইলার ) আমার আজন্ম বন্ধু । কলেজ জীবন পর্যন্ত ওদের সংঙ্গে ছিল জমজমাট আড্ডার সম্পর্ক । বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার পর থেকে শহর মুন্সীগনজ , গোয়াল পাড়া , দোস্ত ছোটকা এবং সকল বন্ধুদের সাথে আমার যোগাযোগ ক্রমশ শিথিল হয়ে আসে । দেখা হয় অনিয়মিত। পেশা এবং নেশার মগ্নতায় একটা সময় দেখা-সাক্ষাত একেবারে শূণ্যর কোঠায় চলে আসে । না-দেখার দুই যুগ চলে যায় । তারপর যখন জন্ম শহরে ফিরে আসি তখন শহর মানুষ সব কিছু পাল্টে গেছে । বন্ধুরা সব
নিরুদেশ । যাঁরা আছে তাঁরা পঞ্চাশ উর্ধ প্রবীন , অ-কালে ভাটি গাঙ্গের মাঝি ।
বন্ধু ছোটকার সাথে দেখা হয় । ছোটকা কথা-বার্তায় স্বভাবে সেই নিষ্পাপ বালকই রয়ে গেছে । পরিবর্তন হয়েছে বাহ্যিক । পোশাক-পরিচ্ছদে আধ্যাত্মিক ছাপ ।
ঋষি সুলভ আসন বসন । ভাবলাম ছোটকা কি সাধু-সন্যাসী হয়ে গেল ! খোঁজ
নিয়ে জানলাম ওর বিয়ে-শাদী ঘর-সংসার
হয়নি । আধ্যাত্মিক জীবন চর্চা বেছে নিয়েছে । একদিন ওদের গোয়াল পাড়ার বাড়ির পুরনো দালানে গিয়ে খোঁজ করি । ওর বড় ভাই দীপক দা এবং মেঝ ভাই মাইঝা বলল , ছোটকা নিচে টিনের চালা ঘরে থাকে । আমি নিচে এসে ছোট্ট নড়বড়ে টিনের চালা ঘরে ওকে আবিষ্কার করলাম অতিশয় দুস্থ বেশে , শুয়ে আছে মলিন বিছানায় বিছানার সংঙ্গে মিশে ।
বদ্ধ ঘরে দিনের আলো নেই । উচ্ছিষ্ট পরে আছে একটি ছোট্ট টেবিলে । ঘরে জুড়ে উৎকট গন্ধ । জিজ্ঞেস করে জানলাম ভাইয়েরা টুকটাক খাবার দেয় , আবার বাইরে কিনে খায় – এই রকম চলে জী।